পৃথিবীর জন্ম থকে মানব জাতির হিদায়াতের লক্ষ্যে মহান আল্লাহ অসংখ্য মহামানব সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের মাঝে কেউ নবী কেউ ওলী। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নবী প্রেরণের ধারাকে খতম করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মানবজাতিকে প্রভুর পথে পরিচালনার ধারা মহাপ্রলয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এ ধরায় হিদায়াতের রাজপথে পথভোলা আপামর গণমানুষকে পরিচালনার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আসছেন আল্লাহর ওলী সমাজসংস্কারক মুজাদ্দিদ শ্রেণি। তাঁরা অনেক ত্যাগ বিসর্জন দিয়ে সীমাহীন কষ্ট করে মানবতাকে আলোর পথ দেখিয়ে থাকেন। জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুÐ থেকে বাঁচাবার দৃঢ় প্রত্যয় ও উচ্ছ¡াসে কাজ করে থাকেন। পরম আয়েশী বিলাসী জীবনযাপনের শত সুযোগ থাকা সত্তে¡ও নির্লোভ নির্মোহ মুসাফিরি জীবন নিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে চলেন দুর্বার ও বিরামহীন গতিতে। আলোর মশাল জ্বালিয়ে মানুষকে বাতলে দেন- এটা সত্য সুন্দরের পথ, আলোর পথ, শান্তি ও মুক্তির রাজপথ; আর ওটা- তাগুত ও শয়তানের সরুগলি, আঁধার ও বিপদজনক পথ, অশান্তি অকল্যাণের ভ্রান্তপথ। এ সকল মনীষার মাঝে হযরত আল্লামা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ. ছিলেন অন্যতম।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জন্ম নেয়া ‘আলম’ আমাদের রেঁনেসার অগ্রপথিক আল্লামা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ. যেমন ছিলেন বিখ্যাত ওলী তেমনি ছিলেন সমাজসংস্কারক মুজাদ্দিদ। ‘বরুণার পীর সাহেব’ নামে খ্যাত হলেও তিনি ছিলেন সমাজসেবক, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক, কবি, বর্ষীয়ান আলেম এবং মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলাসহ বি-বাড়িয়া, নেত্রকোণা, মোমেনশাহী, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী ইত্যাদি জেলায় হযরত শায়খে বর্ণভীর দাওয়াতী মাহফিল ও শেষরাতের আবেগভরা কান্নার রোল গণমানুষকে শিহরিত করত। এ সব জেলায় তাঁর ভক্ত মুরীদানের সংখ্যা কত- তা বলা কঠিন।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫নং কালাপুর ইউনিয়নের বরুণা গ্রামে হযরত আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি হামিদ উল্লাহ ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। জানা যায়, মুন্সি হামিদ উল্লাহর পূর্ব পুরুষগণ শেখ বুরহান উদ্দীনের বংশধর ও সিলেটের বাসিন্দা ছিলেন। পরবর্তীতে মৌলভীবাজারের ভানুগাছে বসতি স্থাপন করেন। এই বরুণাতেই হযরত শায়খে বর্ণভীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা মুন্সি হামিদ উল্লাহর নামে এলাকার নাম হয় হামিদনগর।
হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন স্বীয় পিতা মুন্সি হামিদ উল্লাহর নিকট। পরবর্তীকালে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। সেখান থেকে ১৯৩৬ সালে/১৩৪১ বাংলায় বিশ^বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে ৬ বছর লেখাপড়া করে দাওরায়ে হাদীস সমাপণ করেন। সে সময়ে দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস ছিলেন হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.। হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. ছাত্র অবস্থায়ই শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর নিকট বাইআত হন। শিক্ষা সমাপণের পর ঐতিহাসিক সাত্তা মসজিদে আধ্ম্যাত্মিক চিল্লা দেন। সেখানেই ১৯৪১ সালে/১৩৪৬ বাংলার মাঘ মাসের ১০ তারিখে স্বীয় শায়খ মাদানী থেকে বাইআতের ইজাযতপ্রাপ্ত হন। এ বছরের শেষের দিকে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৪১ সালে দেশে ফিরে তিনি মৌলভীবাজারের প্রসিদ্ধ মাদরাসা দারুল উলূমে শিক্ষকতা করেন। সেখানে ১০ বছর শিক্ষকতার পর ১৯৫১ সালে নিজ গ্রামে পৈতৃক ভ‚মিতে আনওয়ারুল উলূম হামিদনগর বরুণা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হযরত বর্ণভীর রেখে যাওয়া সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বরুণা মাদরাসা ও আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। ১৯৫১ সালে বরুণা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনসাধারণের মাঝে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা বিস্তারের জন্যে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ১৯৪৪ সালে/১৩৪৯ বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর ১৯৭৩ সালে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন বিষয়ক মাসিক হেফাজতে ইসলাম পত্রিকা প্রকাশ করেন।
হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. মহান মালিকের পবিত্র ঘর কাবাতুল্লাহর হজ পালনের জন্যে ১৯৫৪ সালে/১৩৫৯ বাংলায় ১২ বৈশাখ শুক্রবার মক্কার উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে জাহাজে চড়ে যাত্রা করেন। পবিত্র হজ পালন করে এক মাস মদীনায় ও দুই মাস মক্কায় অবস্থান করেন।
হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. ছিলেন দ্রোহের মিনার। ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছিলেন আপোসহীন। তিনি তাগুত ও কুফুরী শক্তির মুকাবিলায় খোলা-তরবারির মতো ঝলসে উঠতেন। ১৯৬১ সালে আইয়ূব খানের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানের আলেমদের শীর্ষ নেতা হিসেবে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশের সভাপতিত্ব করেন। কারণ সেখানে শরীয়া আইনের রদবদল করা হয়েছিল।
মানুষকে আল্লাহমুখী করার জন্য তিনি ছিলেন সদাতৎপর। আরাম আয়েশকে ‘না’ বলে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সকল এলাকায়। তাঁর আবেগপূর্ণ দরদী বক্তৃতায় হাজার হাজার মানুষের হৃদয় বিগলিত হতো। হিদায়তের উজ্জ্বল আলোয় পথভোলা মানুষ সুপথে ফিরে আসত। দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে আমজনতাকে জ্ঞান দান করার মানসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম।
হযরত শায়খে বর্ণভী ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্ব। তাঁর শেষ রাতের আবেগভরা কান্না আর রোনাজারি রাতের নীরবতা ছিন্ন করে আকাশে বাতাসে প্রভুপ্রেমের জয়গান ধ্বনিত হতো। তাঁর সাথে কাঁদত হাজার হাজার ভক্ত-মুরীদান। জীবনে যাঁরা অন্তত একবার হযরত শায়খে বর্ণভীর দুআ মাহফিলে শরীক হতে পেরেছেন তাঁরা সে দুআকে জীবনের স্মরণীয় দুআ হিসেবে মনে করতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি মাওলার দরবারে কেঁদে কেঁদে দুআ করতেন। সিলেটে আপামর জনতার মাঝে আজও তাঁর লিখিত ‘মুনাজাতে মকবুলের’ পঙক্তি মধুরকণ্ঠে উচ্চারিত হয়। ওয়াজ মাহফিলে মুনাজাতে মকবুলের দুআ আজও মানুষকে কাঁদায়।
শায়খে বর্ণভী রহ. তাঁর পিতার মতো তিনিও ছিলেন একজন ফার্সী কবি। এ ছাড়া সিলেটি ভাষায় লিখিত ‘মুনাজাতে মকবুল’ মরমী কবিতায় এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আলেম ও বর্ষীয়ান পীর। সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন যুগসচেতন মানুষ। আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই তিনি মিডিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন সময়ের গণমাধ্যম মাসিক হেফাজতে ইসলাম। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এ পত্রিকার মাধ্যমে শত শত আলেমের হাতে কলম উঠে এসেছে। তিনি তৈরি করলেন অসংখ্য সম্পাদক ও সাংবাদিক।
হযরত শায়খে বর্ণভী ছিলেন আর্ত-মানবতার সেবায় একজন নিবেদিতপ্রাণ উন্নয়নকর্মী। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন দরিদ্র মানুষের বন্ধু। অভাব-অনটনগ্রস্ত মানুষের ত্রাণকর্তা। তাঁর জন্মভ‚মিতে হতদরিদ্র মানুষকে দুহাতে অর্থকরি বিলিয়ে দিতেন। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ সামাজিক উন্নয়নে তাঁর বলিষ্ট অবদান ভুলতে পারবে না এলাকাবাসী। তাঁর রেখে যাওয়া মিশন হেফাজতে ইসলামের হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স, স্বাস্থ্যক্যাম্প, সেনিটারি টয়লেট নির্মাণ, টিউবওয়েল বিতরণ, রিক্সা-টেলাগাড়ি বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি তাঁর উত্তরসূরিরা সুচারুভাবে আঞ্জাম দিচ্ছেন। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, কুরবানীর গোশত বিতরণ ও বাগেরহাট জেলার সিডর বিধ্বস্ত এলাকায় মসজিদ মাদরাসার উন্নয়নে ভ‚মিকা রেখে চলেছে হেফাজত ইসলাম ইউকে।
হযরত শায়খে বর্ণভী ছিলেন প্রাগ্রসর চিন্তার বিচক্ষণ আলেমে দ্বীন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ আলেমদের থেকে তাঁর অবস্থান ছিল বিপরীত মেরুতে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন সমাবেশে যুদ্ধজয়ের দুআ করতেন। তাঁর বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। সংখ্যালুঘু স¤প্রদায়ের নারী-পুরুষ নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছিল তাঁর সান্নিধ্যে। যুদ্ধের সময়ে সংখ্যালুুঘু স¤প্রদায়ের লোকদের স্বর্ণ জেওর-অলংকার, টাকা-পয়সা তাঁর কাছে আমানত ছিল। যদিও তিনি সরাসরি যুদ্ধ করেননি, তথাপি তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা সুহৃদ শুভাকাক্সক্ষী ও সংগঠক।
হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. অল্প বয়সে অধিক সফর করার কারণে শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৬/১৭ বছর যাবৎ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে ১৯৭৭ সালের ১৭ মে মঙ্গলবার এ পৃথিবীর সফর শেষ করে মহান মাওলার সান্নিধ্যে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
শায়খে বর্ণভী রহ. ৭ ছেলে ও ৫ মেয়ে রেখে যান। ছেলেরা হচ্ছেনÑ ১. হযরত মাওলানা শায়খ খলীলুর রহমান হামিদী রহ., ২. হযরত মাওলানা সাইদুর রহমান বর্ণভী, ৩. আলহাজ হাফেজ হামিদুর রহমান, ৪. হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ রশীদুর রহমান ফারুক বর্ণভী, ৫. মরহুম শফীকুর রহমান (সাবেক এম.পি), ৬. হযরত মাওলানা মুহিবুর রহমান সালিক ও ৭. হযরত মাওলানা হাফিজ ওলিউর রহমান বর্ণভী।
সকলেই ওলী ইবনে ওলী হিসেবে গড়ে উঠেছেন। সেমতে তাঁর সন্তানের সন্তানরাও পিতার রেখে যাওয়া কর্মপদ্ধতিতে ইসলাম ও জাতির খেদমত করে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, হযরত শায়খে বর্ণভীর বংশধরদের মাঝে প্রায় দেড় শতাধিক আলিম-হাফিয দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।
মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক
কেন্দ্রীয় নাযিমে তরবিয়ত, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ