ফেদায়ে ইসলাম আল্লামা খলীলুর রহমান হামিদী রহ. কুতবে দাওরান হযরত বর্ণভী রহ.-এর বড় সাহেবযাদা। শায়খে বর্ণভীর ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। বরুণা মাদরাসা ও আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ইন্তেকাল অবধি তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে। শায়খে বর্ণভীর যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। ছিলেন ইলমে, আমলে, আফকারে সমৃদ্ধ যামানার অন্যতম এক বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব।
৩ জিলহজ ১৩৬১ হিজরী, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ বাংলা, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৪১ ঈসায়ী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক নাম মুহাম্মদ খলীলুর রহমান হলেও শায়খে বর্ণভী রহ. তাঁর বড়পুত্রকে আদর করে ডাকতেন ‘মানিক মিয়া’ নামে। তাঁর মায়ের নাম মরহুমা নূরুন্নেছা মমতাজ বেগম।
শৈশবেই তিনি অন্য দু-চারটি শিশুর চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র-ভদ্র ও কোমল স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। শৈশবকালেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে অনন্য গুণাবলি দান করেছিলেন। এ জন্যই হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. তাঁর কলিজার টুকরা ‘মানিক মিয়া’কে লক্ষ করে বলতেন, ‘আমার এই সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে ওলী হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছে।’
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা তিনি নিজের দাদা হযরত আব্দুল হামিদ রহ., পিতা হযরত লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ. এবং আরও কজন বিজ্ঞ আলেমের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেন। অতঃপর জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে হেদায়া জামাতে ভর্তি হন। হযরত আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর একান্ত ¯েœহাশীষ ও সুহবতপ্রাপ্ত হন জামিয়া ইমদাদিয়ায়। সেখানে দুবছর অধ্যয়নের পর গমন করেন জামিয়া বিন্নুরী টাউন পাকিস্তানে। ফলে বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ.-এর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন। জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিনুরী টাউনে তিনি অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে মিশকাত ও দাওরা (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। তিনি সেখানে আল্লামা বিন্নুরী রহ.-এর কাছে বুখারী শরীফের দরস গ্রহণের পাশাপাশি পাকিস্তানের মুফতিয়ে আযম আল্লামা ওলী হাসান টুঙ্কী রহ.-এর তিরমিযী শরীফের দরসে বসে তাঁর অনবদ্য তাকরীর লিপিবদ্ধ করে তিরমিযী শরীফের এক অনন্য শরাহ সংকলন করেছিলেন। যে মূল্যবান পাণ্ডুলিপিটি ২০১৯ সালে বৃহৎ কলেবরে দুই খণ্ডে ‘আনওয়ারুত তিরমিযী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর তাফসীর শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জনের জন্য সেখানে তাফসীর বিভাগে ভর্তি হয়ে হাফিযুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ.-এর কাছে ইলমে তাফসীরে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। হাদীস ও তাফসীরে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের পর হযরত বিন্নরী রহ. পাকিস্তান বোর্ডে সর্বোচ্চ নাম্বার অর্জনকারী, প্রখর মেধাবী, উত্তম আমল-আখলাকের অধিকারী তাঁর এই ছাত্রকে নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি স্বীয় পিতা হযরত শায়খে বর্ণভী রহ.-এর অসুস্থতার খবর শুনে দেশে চলে আসেন। পাকিস্তানে তাঁর সাথীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত বিন্নুরী রহ.-এর সুযোগ্য জামাতা শহীদে ইসলাম আল্লামা হাবীবুল্লাহ মুখতার রহ.।
হযরত ফেদায়ে ইসলাম রহ. দেশে ফেরার পর কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে কয়েক মাস অবস্থান করে বিশ্ববরেণ্য শাইখুল হাদিস আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ.-এর বুখারী শরীফের দরসে বসে তাঁর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হন।
কর্মজীবনে পিতার ইন্তেকালের পর বরুণা মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেখানে সুদীর্ঘ ৬০ বছর বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদসহ হাদীসের অমর গ্রন্থসমূহের দরস প্রদান করে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছেন। সাবলীল হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনায় তিনি বুখারী শরীফের দরস প্রদান করতেন। সূ²-সূ² গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়াবলি অনন্য ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করতেন। ইন্তেকাল অবধি উপমহাদেশের এই অন্যতম এই হাদীস বিশারদ বরুণা মাদরাসার হাদীসের মসনদকে অলঙ্কৃত করে রেখেছিলেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কালের নকীব অসংখ্য-অগণিত যোগ্য উত্তরসূরি তৈরী করে গেছেন। তন্মধ্যে হযরতের কয়েকজন প্রথিতযশা শাগরিদ হচ্ছেন, শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল বারী ধর্মপুরী রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি রশীদুর রহমান ফারুক বর্ণভী (বর্তমান আমীরে আঞ্জুমান), শায়খুল হাদীস অধ্যাপক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী ইন্দেশ^রী, মাওলানা আব্দুস সালাম চৌধুরী কানিকিয়ারী রহ., অধ্যক্ষ মাওলানা আবদাল হোসেন খান, শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ওলীউর রহমান বর্ণভী প্রমুখ।
বরুণা মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ইসলাম, দেশ ও জাতির বৃহৎ খেদমত আঞ্জাম দিতে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। ফলে হযরত শায়খে বর্ণভীর ইন্তেকালের পর আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর হাল ধরেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন ইসলামের ছায়াতলে এক ও নেক থাকতে পারে, মহান পিতার সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইন্তেকাল পর্যন্ত আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সমূহ কাজ-কর্মের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন মাসিক হেফাজতে ইসলাম পত্রিকারও।
এ ছাড়া বহু দ্বীনি সংগঠন, সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, অভিভাবক ইত্যাদি পর্যায়ে ভ‚মিকা রেখেছেন। শেখবাড়ি জামিয়া, আল-খলীল কুরআন শিক্ষাবোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল তার বলিষ্ঠ ভ‚মিকা ও অবদান। আমৃত্যু এগুলোর অভিভাবক ও মুরব্বি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের বৃহৎ কওমী শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, সিলেট-মৌলভীবাজারের বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুরব্বি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু।
নিভৃতচারী স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের অধীকারী মহামনীষীতুল্য পুরুষ এই আল্লাহর ওলী তাঁর গোটা জীবন ইসলামের বৃহত্তর কল্যাণ, দরসে হাদীসের ময়দানে উম্মতের ইসলাহ ও মানবসেবায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে শায়খ রহ.-কে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামতে যারা বিশেষভাবে ধন্য, তাআল্লুক মাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যের সুধাপানে যারা সদা তৎপর তাদের হালত বর্ণনা করা অনেকটাই দুঃসাধ্য।
উচ্চতর মেধা-মনন শক্তি, অনন্য সাধারণ জ্ঞান-গভীরতা ও প্রজ্ঞা, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার ইশক-মহব্বতের জ্বলন্ত এক হৃদয় হযরতকে মহিয়ান করে তুলেছিল। শতধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য কাদা ছোড়াছুড়ি হযরতকে প্রায়শই ব্যথিত করে তুলত। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সকল মত ও পথের লোকদের এক আস্থাভাজন মহিরুহ। অভ্যন্তরে সাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থী উদার মানবিকতা তিনি লালন করতেন। তাঁর ইলমী পাণ্ডিত্য, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা এবং যুগশ্রেষ্ঠ আহলে কলব বুযুর্গ হওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁকে সকলেই মান্য করে চলতে দেখেছি।
২৪ আশ্বিন ১৪২৭ বাংলা, ২১ সফর ১৪৪২ হিজরী মুতাবিক ০৯ অক্টোবর ২০২০ ঈসায়ী পবিত্র জুমারাত্রির শেষ প্রহর পৌনে দুই ঘটিকায় এই কালজয়ী মহান মনীষী ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের সময় হযরতের বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। রাব্বে কারীম ক্ষণজন্মা এই মহান মনীষীকে অনন্তকাল জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত রাখুন, এই দুআই করছি আল্লাহ তাআলার দরবারে। আমীন।
অধ্যাপক মাওলানা আব্দুস সবুর
কেন্দ্রীয় মহাসচিব, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ