রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

ইতিহাস

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ : ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি অরাজনৈতিক দ্বীনি সংগঠন। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগঠনটি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে মানবতার কল্যাণে, দ্বীন ও ঈমানের লালন ও সংরক্ষণে এবং মানবিক মূল্যবোধের উজ্জীবনে কাজ করে যাচ্ছে। দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া এবং মানুষকে হিদায়াতের রাজপথে চালিত করা এবং মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলাই সংগঠনটির প্রধানতম লক্ষ্য। ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের সূচনা ও পথচলার ইতিহাসকে উপজীব্য করে হেফাজতে ইসলাম : ইতিহাস ঐতিহ্য  বর্তমান প্রেক্ষিত’ নামে গবেষণাধর্মী ছোট্ট একটি পুস্তিকা রচনা করেন বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও ইসলামী শিক্ষাবিদ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম  এখানে সেই পুস্তিকার চয়িত অংশ পেশ করা হলো।

প্রেক্ষাপট

১৯৪০ সাল, ১৩৪৬ বাংলা। উপমহাদেশজুড়ে স্বাধীনতাসংগ্রাম তুঙ্গে। জেল-জুলুম, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলছে। স্বাধীনতার আকাঙ্খায় সমগ্র জাতি মুখিয়ে আছে। দিকে দিকে স্বাধীন জাতি ও সমাজ গঠনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ১৯৩৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ইউরোপে যুদ্ধ বাধে। ভারতেও তখন একটা থমথম করা ভয়ের ভাব। তখন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে ভারতের স্বাধীনতা লাভে অহিংসা-ই সঠিক পন্থা এবং তারা ঘোষণা করলেন বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাদ ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে ভারতের ন্যায্য স্থান গণতান্ত্রিক শিবিরে। তবে নিজে স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ভারত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর যুদ্ধপ্রচেষ্টায় যোগ দিতে পারছে না। তৎকালীন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ইমামুল হিন্দ মাওলানা আবুল কালাম আযাদের খসড়ার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত আকারে প্রস্তাবগুলো পাশ হয়েছিল। (বিস্তারিত দেখুন : মৌলানা আবুল কালাম আযাদ রচিত ‘ভারত যখন স্বাধীন হলো’ পৃষ্ঠা : ৩১-৩২)। এমনই এক প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে তাযকিয়া ও ইহসানের দীক্ষা ও স্বীকৃতি নিয়ে দেশে ফিরেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নীপুরুষ শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর প্রিয় ছাত্র ও খলীফা হযরত শায়খ মাওলানা লুৎফুর রহমান বরুণী। (দেখুন : দিলরুবা রহমান হামিদী রচিত ‘হায়াতে বর্ণভী রহ.’)

১৯৪২ সাল, ১৩৪৮ বাংলা। তৎকালীন মৌলভীবাজার সাবডিভিশন শহরে প্রতিষ্ঠিত দারুণ উলুম মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শায়খে বর্ণভী রহ.। এর পেছনে শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর ইজাযত ও সুপারিশ ছিল। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার ইন্দেশ্বর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের কৃতিসন্তান শায়খে কৌড়িয়ার বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা আব্দুন নূর রহ.। তিনি ছিলেন হাকীমূল উম্মাত থানভী রহ. ও শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর সহচার্যপ্রাপ্ত এক বুজুর্গ আলেম। (দেখুন-মাওলানা শায়খ তাজুল ইসলাম রচিত ‘চলমান জালালাবাদ ইসলামী রেনেসাঁয় অনন্য যাঁরা’ পৃষ্ঠা : ২০৭) দারুল উলূমের প্রতিষ্ঠাকাল ছিল ১৯৩৩ ইংরেজি। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুন নূর বহ, লিখেছেন, ১৩৫৪ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৩ ইংরেজির এক শুভদিনে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতের উপর ভরসাকরত মাদরাসার প্রাথমিক তালিম শুরু করি। (দেখুন তৎপ্রণীত ‘দারুল উলুমের ইতিবৃত্ত’ পৃষ্ঠা : ১-২।) একই পুস্তিকার ৭ পৃষ্ঠায় ‘সুযোগ্য মুদাররিসীন নিয়োগ’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা ও পরিশ্রমকরত (১) হযরত মাওলানা আব্দুল হক চৌধুরী মোখতারপুরী রহ., (২) হযরত মাওলানা আমানুল্লাহ রহ., (৩) হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান বরুনী রহ.কে মাদরাসার সুষ্ঠু তা’লিম ও তারবিয়তের জন্য নিয়োজিত করার সৌভাগ্য অর্জন করি। এতে যেমন মাদরাসার সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে, তেমনি চতুর্দিক থেকে তালাবাও এসে ভর্তি হতে থাকেন।

আগের আমলে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য জায়গির ব্যবস্থা ছিল। শায়খ মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ. দারুল উলুমে নিয়োগ লাভের পর মাদরাসার শিক্ষার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। একই সাথে ছাত্রদের চরিত্র গঠনে মনোনিবেশ করেন। তাঁর জায়গির ছিল শাহ বন্দরের বরাবর মনু নদীর অপর পারে সবুজের ছায়াঢাকা বালিকান্দি গ্রামে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে রোজানা মাদরাসায় যাতায়াত করতেন হযরত শায়খে বর্ণভী রহ। বালিকান্দির ডা. আব্দুল্লাহ সাহেবের বাংলাঘরে থাকতেন তিনি। হাজী আব্দুল্লাহ মরহুম ও তাঁর ভাইয়েরা বসবাস করতেন এ বাড়িতে। সেই বাড়ির বাংলো, মসজিদ এবং যাতায়াতের পথে সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর যোগাযোগ ও আলোচনা হত। এতে করে হযরত শায়খে বরুণীর মনোজগতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীন পৌঁছে দেয়ার চিন্তার উদ্রেক হয়। বালিকান্দি গ্রাম একটি প্রচীন ঐতিহ্যবাহী জনবসতি। সৈয়দ শামসুল ইসলাম রহ. রচিত ‘হেকিম মাওলানা সৈয়দ নজির উদ্দিন’ গ্রন্থের ভূমিকায় ঐতিহ্য সন্ধানী ইতিহাস লেখক দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী লিখেছেন- ‘বালিকালি নিবাসী পীর শাহ সায়্যিদ মরহুম আলীর (উরফে রাফাছত আলীর) দাদাপীর ছিলেন জৈনপুরী রহ.। তিনি ছিলেন জিহাদী আন্দেলনের নেতা, সিপাহী বিপ্লবের বীর মুজাহিদ মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী রহ.-এর সিলসিলাভুক্ত। এ গ্রামের অনেক কৃতি পুরুষ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন সৈয়দ শামসুল ইসলাম রহ. রচিত ‘অনেক দিনের অনেক কথা’ ১ম ও ২য় খণ্ড।

সেই সময় বালিকান্দি গ্রামের ডা: আব্দুল্লাহ সাহেবের দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। মামলা-মোকদ্দমাও চলছিল। বাংলাঘরে। এ নিয়ে প্রায়ই এক পক্ষের লোকজনের শলা-পরামর্শ হতো, বৈঠক বসতো। মামলা পরিচালনার জন্য চাঁদা তোলা হতো। হযরত শায়খে বর্ণভী রহ. এ অবস্থা দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কীভাবে এই বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকলেন। তাঁরা যেহেতু প্রায়ই এখানে বসেন তাই তিনি একবার প্রস্তাব দিলেন যে আপনারা সম্মত হলে এখানে সপ্তাহে একদিন তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করা যেতে পারে। তারা সহজেই সম্মত হলেন। শায়খ সূরা ইউসূফের তাফসীর শুরু করলেন। দুই মাস যাবৎ এই সূরার তাফসীরই চলতে থাকলো এর মধ্যেই পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আলোচনা করলেন। সৈয়দ বাড়ি ও হাজীবাড়ির লোকজনের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব রাখলেন। উভয় পক্ষ তাতে রাজি হলেন। এক পর্যায়ে তাদের দীর্ঘ দিনের বিরোধ মিটে গেল। উভয় পক্ষ তাদের মামলা-মোকদ্দমা তুলে নিলেন। গ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হলো।

এ গ্রামেই একটি মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ওরশ হতো। শায়খ এ বিষয়ে ভাবতে থাকেন। মানুষকে ঈমান ও আমলের পথে পরিচালিত করতে এবং পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে তাঁর চিন্তা এগুতে থাকলো। তিনি গ্রামের যুবকদের একত্রিত করলেন। তাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে তাদের সাথে একাকার হয়ে কাজ করতে থাকলেন।

বালিকান্দি গ্রামে হেফাজতে ইসলাম কমিটি

তাদেরকে তাফসীর মাহফিলের সাথে সম্পৃক্ত করলেন। নির্মল খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চায় মাঝে মধ্যে নানা প্রকার প্রতিযোগিতার আয়োজন চলতে থাকলো। গ্রামের কিশোর যুবকদের মধ্যে মেলা-ধূলার প্রতিযোগিতা হতো। দৌঁড় ও লাঠিখেলা প্রতিযোগিতা হতো। শায়খে বর্ণভী রহ. গ্রামের মানুষের নিকট থেকে কালেকশন করে নিজে হাজির থেকে প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করতেন। এমনি করে গ্রামের কিশোর-যুবকদের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন শায়খে বর্ণভী রহ.। গ্রামের যুবসমাজ সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠলো। তাদের নিয়ে যে কমিটি করা হয়েছিল এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘হেফাজতে ইসলাম কমিটি’। এটা ছিল ১৯৪৪ সালের ঘটনা/১৩৪৯ বাংলা। এ সম্পর্কে দিলরুবা রহমান হামিদী তার রচিত হায়াতে বর্ণভী রহ.-এর ২৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, দারুল উলূম থাকা অবস্থায় যুগের সংস্কারক হযরত শায়খে বর্ণভী রহ.-এর অন্তরে আলোড়ন জাগিয়ে তোলে অরাজনৈতিক আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। তখন ১৩৪৯ বাংলা, হেফাজতে ইসলামের সূচনা হলো।

পরবর্তীতে বালিকান্দি গ্রামের মাজারকেন্দ্রিক ওরশকে সৎকর্মে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মাজারের কাছে বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। যুবকেরা এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই আয়োজন করতে গিয়ে গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ ও মুরব্বিদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়। মাহফিলে সবাই আন্তরিক সহযোগিতা করেন এবং স্থানীয়ভাবে এর নামকরণ করা হয়। ‘হেফাজতে ইসলাম কমিটি বালিকান্দি’। এটা ১৯৪৫/৪৬ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৫১/৫২ বাংলার ঘটনা।

বালিকান্দি গ্রামের সাথে শায়খের সম্পর্ক ছিল বড়ই মধুর ও গভীর। গ্রামবাসীর প্রতি ছিল তার প্রবল অনুরাগ ও ভালবাসা। তাদের প্রতি তারও অবদান ছিল। আবার গ্রামবাসীও তাকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও অনুসরণ করতেন। তাদেরও অনেক অবদান, সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল শায়খে বর্ণভীর বীনি দাওয়াত ও খেদমাতের প্রতি। শায়খ বর্ণভী রহ. তাদের জন্য প্রাণভরে দু’আ করতেন। এ গ্রামের মানুষকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শায়খ বর্ণভীর চিন্তাজগতে নতুন ফিকির জন্ম নিল। তিনি সমগ্র দেশের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত ও তাঁর সূচিতে সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখলেন। কেবল মাদরাসা-মসজিদ নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। আপামর জনসাধারণের হেদায়াতের ভাবনা তাঁকে তাড়িত করতো প্রতিনিয়ত। মানুষের প্রতি তাঁর অনাবিল দরদ ও ভালবাসা ছিল। মানব সমাজের অশান্তি আর বিভ্রান্তি তাঁকে বাবুল করতো। রাত-দিন তিনি এ নিয়ে ভাবতেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে আলীশানে সাহায্য চাইতেন। তাঁর অবস্থা ছিল অনেকটা মাওলানা ইলিয়াস রহ. (জন্ম-১৩০৩ হিজরী- মৃত্যু ১৩৬৭/১৯৪৪ইং)-এর মতো। তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহ ও মানব জাতির হিদায়েতের চিন্তায় ব্যাকুল। তার ফিকিরেরই ফসল আজকের পৃথিবীতে ইসলামের পুনরুজ্জীবিত ব্যাপক দাওয়াতী কার্যক্রম তাবলীগ জামাআত। বাংলা ভাষায় মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ.-এর জীবনী লিখেছেন মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। যা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রকাশকের কথার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রব লিখেছেন- খ্রিষ্টীয় সাত শতকে আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে আরব ভূখণ্ডে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। অচিরেই তা মানবগোষ্ঠীর একটি প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। কোটি কোটি মানুষের ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ ধর্ম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে জাগতিক আকর্ষণহীন মুসলিম মুবাল্লিগগণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কার্যত, ইসলামের প্রথম যুগে যে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, প্রায় দেড় হাজার বছর পর এসে আজও তা সমানভাবে গতিশীল।

এই দাওয়াতী কার্যক্রমের এক বিপুল শ্রমসাধ্য অথচ আন্তরিক প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় বিগত শতকে এই উপমহাদেশে। কেবল অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার নয়, এর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদেরকেও ইসলামী শিক্ষা, দীনি প্রশিক্ষণ, ঈমান ও আমলের ইসলাহের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক অনুসরণে উদ্দীপ্ত করা। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পরাধীন ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে এ কার্যক্রম বিপুল সাফল্য লাভ করে। পরবর্তীতে তা উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভের মাধ্যমে এক বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং বিপুল খ্যাত ‘তাবলীগ জামাত’ সুসংহত সাংগঠনিক রূপ লাভ করেছে। এ তাবলীগ জামাত আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সাধনারই ধারাবাহিকতা।

এ ইসলাহী কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ হলেন ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের কৃতি ছাত্র, সমকালীন শীর্ষ আলেম মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ.। উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম ও ধর্মীয় সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ দেহলভী রহ.-এর সংগ্রামী চিন্তাধারার বলিষ্ঠ অনুসারী এই যুগনায়ক পুরুষ নিজে ছিলেন প্রচার বিমুখ এবং নিরলস এক কর্মসাধক। তাঁর অসাধারণ কর্মনিষ্ঠা ও দিকনির্দেশনার ফসল ‘তাবলীগ জামাত’-এর কার্যক্রম ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।

আমরা গভীরভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখি হযরত মাওলানা ইলিয়াছ রহ.-এর সাথে দেওবন্দের আরেক কৃতি সন্তান মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.-এর ফিকির, চিন্তাধারা, মানবতার প্রতি দরদ ও তাদের জন্য পেরেশানির ক্ষেত্রে মিল ছিল। তিনিও ছিলেন ইমামূল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভীর মানস পুত্র। মাওলানা ইলিয়াছ সাহেব কাজ শুরু করেছিলেন মেওয়াতে আর পুতফুর রহমান সাহেব কাজ শুরু করেছিলেন বালিকন্দিতে। এমনিভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দু’জনের কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

শায়খে বর্ণভীর নতুন ফিকির এবং সংগঠনের বিস্তৃতি

বালিকান্দির কাজের অগ্রগতি তাঁর সামনে একটি নমুনা হয়ে ধরা দিয়েছিল। তিনি এই ধারণাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে হিদায়াতের বার্তা, শান্তি, সম্প্রীতি ও ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথে জনমানুষকে চালিত করার কাজে উদ্যোগী হলেন। উল্লেখ্য যে তাবলীগ জামাআতের সাথে হেফাজতে ইসলামের কাজের কোন দন্দ্ব নেই। বরং উভয়ের কাজ বলা যায় একই লক্ষ্যে পরিচালিত। অবশ্য সে সময় তাবলীগের কাজ এতদঞ্চলে বিস্তার লাভ করেনি। এজন্য শায়খ সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো এবং তাদেরকে প্রাথমিকভাবে ইসলামের হুকুম-আহকাম প্রতিপালানে অভ্যস্ত করার একটি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলেন।

এরপর চিন্তা করলেন এ কাজের প্রতি দেশের শীর্ষ আলেমদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। নতুবা নতুন সংকট তৈরী হবে। এজন্য তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকলেন। তিনি ভাবলেন উলামা মাশায়েখের অনুমোদন এ কাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে। মৌলভীবাজার সদরের কনকপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী হাজী আব্দুস সাত্তার ছিলেন শায়খের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। তিনি তাঁর বাড়িতে বড় বড় আলেমদের দাওয়াত করে এক দু’আর মাহফিলের আয়োজন করেন। এ মাহফিলে তৎকালীন সিলেট জেলার শীর্ষ আলেমগণ অংশ নেন। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, মাওলানা বশীর আহমদ শায়খে গৌরকরণী রহ., মাওলানা শামছুল ইসলাম শায়খে শেরপুরী রহ., মাওলানা হাবীবুর রহমান রামপুরী, মাওলানা মুজাফ্ফর আলী বানিয়াচঙ্গী, মাওলানা আব্দুন নূর ইন্দেশ্বরী রহ., মাওলানা আলী আসগর নূরী শায়খে কামারগাঁও রহ. প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রাতে তাঁরা এ বাড়িতেই অবস্থান করেন। দুআর পর্ব শেষ হয়। পরদিন ফজরের জামাআতে ইমামতি করেন শায়খে বর্ণভী রহ.। নামাযের পর তিনি সমবেত শীর্ষ আলেমদের খেদমতে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে শিরক-বিদআত রকমারি কুসংস্কার ধর্মের নামে অধর্ম আর বিভ্রান্তির চিত্র তুলে ধরে এক আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। মানুষের হিদায়াতের নিমিত্তে আলেমদের কাজ করার গুরুত্বের বিষয়টি উপস্থাপন করেন। একই সাথে তিনি বালিকান্দির অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন। মজলিসে উপস্থিত সকল উলামা তাঁর বক্তব্য ও চিন্তার সাথে একমত পোষণ করেন। নিজের ফিকির, চিন্তা আর পেরেশানি অন্যের মধ্যে সঞ্চার করতে পেরে শায়খ পুলকিত, আনন্দিত।

সিলেটে উলামা সম্মেলন  আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম পাকিস্তান নামে সংগঠনের আনু্ষ্ঠানিক পথচলার সূচনা

ঐ মজলিসেই মাওলানা হাবিবুর রহমান রায়পুরী রহ.-এর প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে হযরত বর্ণভী রহ.-কে আমীর নিযুক্ত করে আঞ্চলিকভাবে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালু করা হয়। সিদ্ধান্ত হলো যে, তৎকালীন জেলা শহর সিলেটের বন্দর বাজার জামে মসজিদে আরো বড় পরিসরে উলামা সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক কাজের সূচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। উপস্থিত সকলে এ নিয়ে কাজ করতে সম্মত হলেন।

পরবর্তীতে সিলেটে উলামা সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়। বন্দর বাজার জামে মসজিদে বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সকল শীর্ষ আলেম সমবেত হলেন। আল্লামা মুশাহিদ রায়মপুরীসহ সিলেটে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর খলিফাগণ, বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিমগণ, মুহাদ্দিসীন, ইমাম ও খতীবগণের উপস্থিতে সমাবেশ শুরু হলো। সভাপতি করা হলো মাওলানা বশীর আহমদ শায়খে বাঘাকে (জন্ম-১৮৯৫, মৃত্যু-১৯৭১)। উদ্বোধনী ও স্বাগত বয়ান পেশ করেন শায়খে বর্ণভী রহ.। তিনি এ সমাবেশের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট সকলের সামনে তুলে ধরেন। সমাবেশে উপস্থিত সকলে তাঁর চিন্তাচেতনার সাথে একমত পোষণ করেন।

পরে প্রশ্ন আসে কী নামে কাজ করা হবে? বিস্তারিত আলোচনার পর আল্লামা রায়মপুরী প্রস্তাব করেন, ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ নামে কাজ শুরু করা যায়। শায়খে বর্ণভী রহ. বালিকান্দির কাজের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রস্তাব করেন, ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে কাজ করতে। ব্যাপক আলোচনার পর বিষয়টি ভোটাভুটিতে যায়। এতে শায়খ বর্ণভীর প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু শায়খে কৌড়িয়া রহ.-সহ কয়েকজন বললেন, বিষয়টি (কুরাতে) লটারিতে ফায়সালা করতে। লটারিতে পরপর তিন বার ‘হেফাজতে ইসলাম’ নাম উঠলো। শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে এ জীনি দাওয়াত ও সংস্কার কার্যক্রমের নাম দেয়া হলো আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম পাকিস্তান। সর্বসম্মতিক্রমে এর আমীর করা হলো মাওলানা শায়খ লুৎফুর রহমান বর্ণভীকে। সম্পাদক করা হলো মাওলানা আব্দুর রব শায়খে ইছামতিকে। এমনি করে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহৎ পরিসরে যাত্রা শুরু হলো হেফাজতে ইসলামের। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। এ জন্য আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর শুরুর দিককার গঠনতন্ত্রে লেখা আছে—১৯৫৪ সালে সিলেটে এর জন্ম। (তবে যেহেতু বালিকান্দি গ্রাম থেকে ১৯৪৪ সালে এর মূল যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাই বর্তমানে অফিসিয়ালি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দকেই আঞ্জুমানের প্রতিষ্ঠাসন ধরা হয়।)

এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে হাফেজ মোহাম্মদ নূরুজ্জামান তৎপ্রণীত ‘ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ও সাথীবর্গ’ গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. অনৈসলামিক কার্যকলাপের মোকাবিলা ও সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামী আহকাম আরকানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক একটি অরাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। সংস্থাটির নাম রাখা হয় ‘হেফাজতে ইসলাম’। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এর সদর দফতর রাখা হয়। আবার আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর গঠনতন্ত্রের শুরুতে লেখা রয়েছে এই জামাতের নাম আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম, ১৯৫৪ সালে সিলেট জেলায় এর জন্ম। সিলেট জেলা হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী ইহার বর্তমান কর্মক্ষেত্র। যদিও কর্মক্ষেত্র এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম এর জন্মসন নিয়ে। হাফেজ নূরুজ্জামান লিখেছেন, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে, কিন্তু তিনি কোন নির্দিষ্ট সন উল্লেখ করেননি। পক্ষান্তরে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর পুরনো গঠনতন্ত্রের শুরুতে লেখা রয়েছে এই জামাতের নাম আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম, ১৯৫৪ সালে সিলেট জেলায় এর জন্ম। সে হিসেবে ১৯৫৪ সালকেই আমরা এর জন্মসাল হিসেবে নির্দিষ্ট করতে পারি। যদিও সীমিত পরিসরে অনানুষ্ঠাকিভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এতে করে হেফাজতে ইসলাম-এর জন্মসন নিয়ে দুই বর্ণনার মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয় হয়ে যায়। কারণ, হাফেয মোহাম্মদ নূরুজ্জামান তার গ্রন্থের ১০০ পৃষ্ঠায় ‘হেফাজতে ইসলাম কমিটির ইশতেহার’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘জনগণকে নেক কাজে উদ্বুদ্ধ ও গোনাহের কাজ হতে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে হযরত ফখরে বাঙ্গাল র. ব্রাহ্মবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষ হতে অনেক ইশতেহার প্রকাশ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র পাঁচখানা ইশতেহার বর্তমানে আমাদের কাছে আছে। নিম্নে এগুলো উদ্ধৃত হলো’ বলে তিনি চারটি ইশতেহার তাঁর গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে তিনটি ইশতেহারে তারিখ রয়েছে। সেগুলো হলো ৩০/৭/১৯৬২, ৫/৬/১৯৬৩ এবং ২/৭/৬৩; এর কোনো তারিখই ১৯৫৪ সালের আগের নয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, হেফাজতে ইসলাম-এর জন্মসন ১৯৫৪।

এবারে আরেকটি প্রশ্ন আসে আর তা হলো এই সংগঠনের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা কে? সাধারণত আমরা জানি এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুতুবে দাওরান মাওলানা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ.। কিন্তু হাফেয মোহাম্মদ নূরুজ্জামান তাঁর গ্রন্থের ৯৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ‘অনৈসলমিক কার্যকলাপের মোকাবিলা ও সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামী আহকাম-আরকানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক একটি অরাজনৈতিক সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। সংস্থাটির নাম রাখা হয় ‘হেফাজতে ইসলাম’। ব্রাহ্মবাড়িয়ায় এর সদর দফতর রাখা হয়’।

এই দ্বন্দ্বের সমাধান কী? তাঁরা উভয়েই আমাদের সরেতাজ, বুযুর্গ ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং বাংলার ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ পাওয় যায়। বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবছিলাম বেশ কিছুদিন থেকে। এর একটি সঠিক তত্ত্ব জানার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। আসল ব্যাপারটি জানার জন্য বইপত্র ঘাটাঘাটির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছিলাম। হেফাজতে ইসলামের দীর্ঘদিনের নাযিমে আ‘লা (কেন্দ্রীয় সেক্রটারি) শায়খে বর্ণভী রহ.-এর ঘনিষ্ঠ সহচর ও একান্ত সচিব মাওলানা আব্দুস সালাম চৌধুরী কানিকিয়ারী রহ.-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি এই জটিলতার রহস্য উন্মোচন করেন এবং এর সুরাহা বাতলে দেন। নিম্নে এর সারসংক্ষেপ পেশ করছি

সমকালীন তিন বুযুর্গের তিনটি সংগঠন : কাকতালীয়ভাবে তিনটির নামই হেফাজতে ইসলাম!

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৫০-এর দশক মুসলমানদের স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশা দিয়ে শুরু হয়। পাকিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র এবং কুরআন হবে এর সংবিধান এই ওয়াদা থেকে শাসকগোষ্ঠী সরে আসে। দেশে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের মতই ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ চলতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষ আলেমগণ চিন্তিত হন এবং এই পরিস্থিতিতে তাঁদের করণীয় ঠিক করেন। তাঁরা মাঠে-ময়দানে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি এদেশে ইসলামের চর্চা ও বিকাশে ভূমিকা পালনের জন্য গঠনমূলক কাজ শুরু করেন। মূলত পঞ্চাশের দশকে দেশের তিনটি অঞ্চলে তিনজন চিন্তাশীল, পণ্ডিত বুযুর্গ ইসলামী রেনেসাঁ ও সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা হলেন হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর অন্যতম খলিফা আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ. ও কুতুবে দাওরান আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.। আল্লামা ফরিদপুরী ঢাকা অঞ্চলে, ফখরে বাঙ্গাল কুমিল্লা অঞ্চলে এবং বর্ণভী রহ. সিলেট অঞ্চলে কাজ করেন। কাকতালীয়ভাবে তিনজনই তাদের সংগঠনের নাম রাখেন ‘হেফাজতে ইসলাম’। কে আগে এই নাম রাখেন তা এখন নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও আগে শুরু করেন বর্ণভী রহ.। কারণ তাঁর কাজ ছিল গোছালো, তিনিই গঠনতন্ত্র রচনা ও প্রকাশ করেন। তাছাড়া বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের শুরুতে বালিকান্দির বর্ণিত ঘটনা বিষয়টিকে শক্তিশালী করে। কিন্তু সেকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত না হওয়ায় তাঁদের পরস্পরের কার্যক্রম সম্পর্কে সহসাই জানতে পারেননি। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হয়। তাঁদের মধ্যে যোগাযোগও হয়। সকলেই যেহেতু ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থেই কাজ করছিলেন এবং একই ধারার লোক এ জন্যে বিষয়টি নিয়ে একত্রে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছার ব্যাপারে একমত হন।

তিন বুযুর্গের উদারতা  ঐকমত্য : তিন সংগঠনের সম্মিলিত কাঠামোরও আমীর হলেন শায়খে বর্ণভী

ঢাকার সিদ্দিকবাজার জামে মসজিদে তিন বুযুর্গ ও তাঁদের সাথীবর্গ এক সমঝোতা ও সমন্বয় বৈঠকে মিলিত হন। শায়খে বর্ণভী রহ.-এর সাথে ছিলেন মাওলানা নূরুল হক শায়খে ধরমন্ডলী রহ. ও হবিগন্‌জ জে.কে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শায়খ আব্দুল বারী রহ। এই দুই জনই এ ঘটনাটি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বৈঠকের সভাপতি ছিলেন ফরিদপুরী রহ.। আলোচনা শুরু হলো- কে কীভাবে কাজ শুরু করেছেন বললেন। ফরিদপুরী রহ. বললেন, ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর নামে আমি কাজ শুরু করলেও আমার কোনো কাগজপত্র, গঠনতন্ত্র বা প্রকাশনা নেই। আপনাদের কারো কাছে থাকলে তা পেশ করুন। ফখরে বাঙ্গাল বললেন, আমার কাছেও লিখিত কিছু নেই। এর প্রেক্ষিতে বর্ণভী রহ.-এর নির্দেশে হবিগঞ্জ জে.কে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শায়খ আব্দুল বারী রহ. তাঁর গঠনতন্ত্র পেশ করেন। তাতে পাকিস্তানের আমীরে হেফাজতে ইসলাম হিসেবে বর্ণভী রহ.-এর নাম মুদ্রিত ছিল। তা দেখে উষ্মা প্রকাশ করলেন ফখরে বাঙ্গাল রহ.। তিনি বললেন, আপনাকে কে সমগ্র পাকিস্তানের আমীরে হেফাজতে ইসলাম বানালো? এ ব্যাপারে তিনি অনেক কথা বললেন। অবস্থাদৃষ্টে ধরমন্ডলের শায়েখ সাহেব ও আব্দুল বারী সাহেব ফখরে বাঙ্গালের জবাব দিতে চাচ্ছিলেন। এ দুজন ছিলেন শায়খ বর্ণভী রহ.-এর একান্ত অনুরাগী। কিন্তু ধৈর্যের পাহাড় শায়খে বর্ণভী রহ. তাঁদের থামিয়ে রাখলেন, জবাব বা যুক্তি প্রদর্শনের সুযোগ দিলেন না। তিনি বরং মুচকি মুচকি হাসছিলেন। এ অবস্থায় সমাধানের পথে এগুলেন ফরিদপুরী রহ.। তিনি ফখরে বাঙ্গালকে সম্বোধন করে বললেন, ‘মাওলানা! আমার বয়স হয়ে গেছে অনেক, আপনারও বয়স হয়েছে, আর সিলেটের আলেমগণ যেহেতু এই তরুণ আলেমকে আমীর বানিয়ে ফেলেছেন আর তাঁর কাজকর্মও আপনার আমার চেয়ে অগ্রসর হয়ে গেছে গঠনতন্ত্র এবং অন্যান্য প্রকাশনা রয়েছে এবং তিনি এ নামে আগে কাজ শুরু করেছেন, যদিও আমরা জানতে পারিনি। আর এখন তাদেরই কাজ করার সময় সুতরাং আসুন আমরা একমত হয়ে যাই। শায়খ বর্ণভীকে আমীর মেনে কাজ করি। মহান আল্লাহই হয়তো তাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে জবাব দেওয়ার আমাদের একটা ব্যবস্থাও হয়ে গেল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তো দ্বীনের কাজ হওয়া।’

হযরত ফরিদপুরীর এই আবেগঘন পরদী কথায় ফখরে বাঙ্গালসহ সকলেই একমত হলেন। ফলে সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পুনরায় আমীর নির্বাচিত হলেন শায়খে বর্ণভী রহ.। এরপর সমগ্র পূর্ব বাংলার ১৭ জেলায় কীভাবে কাজ ছড়িয়ে দেয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হলো। ব্যাপক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো যে, সিলেট ও উত্তর বঙ্গের ৮টি জেলা সফর করে কাজ সৃষ্টি করবেন শায়খ বর্ণভী রহ.। ঢাকা বিভাগে সফর করবেন হযরত ফরিদপুরী রহ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে কাজ করবেন ফখরে বাঙ্গাল রহ। তখন বিভাগ ছিল তিনটি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী। সেমতে সমগ্র পূর্ববাংলায় সফর করা হয়। উল্লেখ্য যে, তখন শায়খ বর্ণভী ছিলেন মধ্যবয়সী তরুণ আলেম এবং ফখরে বাঙ্গাল ও ফরিদপুরী রহ. ছিলেন প্রবীণ আলেম।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক শায়খ বর্ণভী উত্তরবঙ্গ সফর করেন। সে সফরে তার সাথী ছিলেন ধরমন্ডলের শায়খ সাহেব মাওলানা নূরুল হক রহ.।

ঢাকার সিদ্দিক বাজারের এই বৈঠকটির সময়কাল নিয়ে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। ঐ বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা কেউ আর বেঁচে নেই। ফলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে হেফজতে ইসলামের সম্পাদক মাওলানা আব্দুস সালাম চৌধুরী অনুমান করে বললেন। ৫৫/৫৬ সালে হবে। পক্ষান্তরে হাফেয মোহাম্মদ নূরুজ্জামান তার গ্রন্থের ৯৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, হেফাজতে ইসলামের পরিচালনার মূল দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে মাওলানার উপরই। পরে মরহুমের অত্যধিক কর্মব্যস্ততার কারণে ৬০-এর দশকে হেফাজতে ইসলামের এক জাতীয় সম্মেলন ঢাকায় আহ্বান করা হয়। সম্মেলনে তিনি সিলেটের মরহুম ও মগফুর মাওলানা লুৎফুর রহমান রহ.-এর উপর হেফাজতে ইসলামের সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করেন।

এখানে ঢাকার সিদ্দিকবাজার জামে মসজিদের সম্মেলনের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু সময়কাল সম্পর্কে তিনিও সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি। হাফেয মোহাম্মদ নূরুজ্জামান তার গ্রন্থে হেফাজতে ইসলামের যে ইশতেহারগুলো প্রকাশ করেছেন সে গুলোর ভাষা প্রমাণ করে যে, এগুলো কেন্দ্রীয় সংগঠনের নয় বরং ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার পক্ষ থেকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো আরো প্রমাণ করে যে, সমঝোতা এবং সমন্বয় বৈঠকের পর যখন ‘হেফাজতে ইসলাম’ ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত সমগ্র পূর্ববাংলার আমীরে হেফাজতে ইসলাম হিসেবে যখন শায়খে বর্ণভীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এ ইশতেহারগুলো এর পরের। কারণ ১ম ইশতেহারের শেষে লেখা আছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে- আরজ গোজার ১.(আল্হাজ্জ মৌলানা) তাজুল ইসলাম, সভাপতি এমনিভাবে মোট ১৯ জন কমিটি সদস্যের নাম রয়েছে। ২য় ইশতেহারের শুরুতেই লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মবাড়িয়া হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে-ইতোঃ পূর্বে ১নং প্রচার পত্র প্রকাশ করা হইয়াছে এবং নাচ-গান ও বাদ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কতিপয় উদ্ধৃতি ঐ প্রচারপত্রে দেয়া হইয়াছে।

এর নিচে লেখা আছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে- আরজ গোজার (মৌলানা) তাজুল ইসলাম, সভাপতি, আব্দুলবারী বি.এল সহসভাপতি, সৈয়দ মোহাম্মদ আহাম্মদ সম্পাদক, মোঃ শহীদুল্লা সৈয়দ মোহা সহ-সম্পাদক, গাজিউর রহমান কোষাধ্যক্ষ, নাছির আহাম্মদ খান, মাজহারুল হক (জমুমিয়া) তাং ৩০/৭/১৯৬২।

৪র্থ ইশতেহারের শেষে লেখা হয়েছে, হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে (মৌলানা) তাজুল ইসলাম- ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫/৬/৬৩ ইং।

৫ম ইশতেহারের শুরুতেই লেখা হয়েছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে জরুরী ঘোষণা। শেষে লেখা আছে- হেফাজতে ইসলাম কমিটির পক্ষে- (মৌলানা) তাজুল ইসলাম ২/৭/৬৩ ইং।

তাহলে প্রমাণিত হয় যে, ঐক্য প্রক্রিয়ার বিষয়টি এর আগে সংঘটিত হয়েছে। পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে আমার মনে হচ্ছে ঘটনাটি ৬০/৬১ সালে হয়ে থাকবে। আল্লাহই ভাল জানেন।

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম ঐতিহ্যগতভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যপ্রয়াসী

আমরা দেখতে পেলাম ঢাকার সম্মেলনে শায়খ বর্ণভী রহ. ছিলেন একেবারে শান্ত, নীরব, ধীরস্থির। তাঁর বিচক্ষণতা, ধৈর্য, প্রজ্ঞা আর ব্যক্তিত্ব সকলের দৃষ্টি কাড়ে। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তিনি মতভেদ আর দলাদলি ঘৃণা করতেন। তিনি রচনা করেছিলেন এই অমর কাব্য—

‘মতভেদ আর দলাদলি পায়ের নিচে দেব ফেলি

মধুর তানে, তান ধরিব— ইল্লাল্লার আযান।

পাগল হয়ে নামর মোরা করব পাগল বিশ্বসারা

জানাই দিব জগতটাকে আমরা মুসলমান।’

শায়খে বর্ণভীর এই কবিতায় তাঁর আলমগিরি ফিকির বা বৈশ্বিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। সমগ্র দুনিয়াকে সামনে নিয়েই তিনি চিন্তা করেছিলেন। যদিও তিনি কাজ শুরু করেছিলেন একটি গ্রামে কিন্তু লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। হেফাজতে ইসলাম খুবই সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। জনগণের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা যুগ যুগ ধরে অম্লান। উলামায়ে কেরাম এবং নেতৃবৃন্দ আন্তরিকতার সাথে সময়ের কুরবানি করলে, যোগ্যতার সাথে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরলে এবং কর্মে নিয়মিত হলে এটা সর্বব্যাপী সংস্থায় রূপ নেবে। শায়খে বর্ণভীর জীবদ্দশায় যদিও হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম দেশের সীমানা পেরোয়নি, কিন্তু বর্তমানে হেফাজতে ইসলাম ইউরোপে বিস্তৃত হয়েছে এবং মানবকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র ‘মাসিক হেফাজতে ইসলাম’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা শায়খে বর্ণভী রহ. নিজে ফিৎনা-ফাসাদ ও ফিরকা-চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে গেছেন। তাঁর জানিশীন হেফাজতে ইসলামের মরহুম আমীর ফেদায়ে ইসলাম শায়খ মাওলানা খলীলুর রহমান রহ.ও সর্বদা ফিৎনা ও সংকীর্ণতা এড়িয়ে চলতেন। পিতা এবং বড় ভাইয়ের মেজাযই পেয়েছেন আঞ্জুমানের বর্তমান আমীর হযরত মুফতি রশীদুর রহমান ফারুক বর্ণভী দা. বা.-ও। আল্লাহ তাআলা তাঁর হায়াতে বরকত দান করুন। আমাদের ওপর তাঁর ছায়াকে দীর্ঘায়িত করুন। আঞ্জুমানের কাজ আরও বেগবান ও কল্যাণকর হোক। আমীন। 

কপিরাইট © ২০২৪ | আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। Developed By Shabaka IT